“আজি হতে কুড়ি বছর আগে”
ঠিক ধরেছেন পাঠক, এই পংক্তিটি “বিশসাল বাদ ” কিংবা “আজি হতে শতবর্ষ পরে” থেকে অনুপ্রানিত I
গত মহালয়ার দিন ভোর বেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে “আশ্বিনের শারদ প্রাতে……..” শুনতে শুনতেই বেশ কয়েকটি এস এম এস , হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ হাজির মোবাইলে “শুভ মহালয়া” ৷ সত্যি , না হলে বোধহয় জানাই হত না সেই দিনটি “মহালয়া” এবং অবশ্যই একটি “শুভ” দিন | পরবর্ত্তীতে ফেসবুক , টুইটারও জানান দিল সগৌরবে যে সেদিন সত্যিই পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু | এবং বিভিন্নভঙ্গীতে দূর্গা ঠাকুরের ছবি / ভিডিও, নানাবিধ ছড়া , শ্লোক সহযোগে ৷ এবং এই প্রবনতা (বা রোগ) মানবসভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চারিত জীবন বা সমাজের প্রতিটি ঘটনা/ অনুষ্ঠান কে ঘিরে ৷
ফলত আমার উপরোক্ত বিষয়ের উদ্রেক ৷
আজ থেকে হতে কুড়ি বছর আগে (তিরিশ / চল্লিশ বছর আগে তো বটেই), তখনও অন্তর্জালের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েনি আস্ত মানবসভ্যতা ৷ ফেসবুক নামক দৈত্যের মায়াজালে মোহগ্রস্ত , আসক্ত হয়ে ওঠেনি যুব সম্প্রদায় ৷ তখনও শরৎ এবং শীতের মাঝে হেমন্ত নামের অধুনা বিলুপ্তপ্রায় ঋতুটি অবশিষ্ট ছিল | প্রোমোটার এবং ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বঙ্গসমাজ | ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের উপর শুভ্র শিউলির অপার্থিব গন্ধে বাতাস তখনও জানান দিত “আশ্বিনের শারদপ্রাতে…… “মহামায়ার আগমনী | তখনও কোন এক “এশিয়ান পেইন্টস” শারদ সন্মানের চক্করে থিম অভিমুখী আবহমান বাংলার “পৃথিবীর সবচেয়ে বড়” দূর্গা রূপে উদ্ভাসিত হওয়ার কোন দায় ছিল না ৷ ঘরে ঘরে টেলিভিশন নামক যন্ত্রদানবের প্রকট উপস্থিতি অনুভূত হয় নি | ফলত মহলয়ার পূণ্য প্রভাতে উৎকট নৃত্য সহযোগে অসংখ্য চ্যানেলে অসহ্য “মেগাসিরিয়াল” সদৃশ অপেরা দেখার যন্ত্রনা ছিল না | ঝরঝরে ট্রানজিস্টরে মহালয়া শোনার অদ্ভুত এক আকুতি ছিল ৷ আজকের মত স্মার্টফোনে ডলবি সাউন্ডের এফ এম রেডিও ছিল স্বপ্নসম । ভোর চারটেতে ঘুম নষ্ট না করে পরে রেকর্ডেড ভার্সন শুনে নেওয়ার মত অপশন ছিল না ৷
বন্ধু আমাকে প্রগতিপন্থী , অসামাজিক, প্রাচীন , বৃদ্ধ ভাবলেও আমার কিছু করার নেই l
আমার ছেলেবেলায় আমাদের ঘরে টিউবলাইট ছিলনা ৷ টিমটিমে হলুদ আলোই ছিল ভরসা ৷ লোডশেডিং হত I বাইরে বেঞ্চে বসে পাড়ার আর চারজনের সাথে হাতপাখার হাওয়া খেতেখেতে জোনাক জ্বলা সন্ধ্যেবেলা তারাভরা আকাশ দেখার অবকাশ ছিল ৷ বিবিধভারতীর নাটকের প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষন ৷ বাড়ীতে প্রথম যখন আপট্রন এর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি এল, প্রতি রবিবার দূরদর্শনে ছায়াছবি দেখতে পাড়ার অনেকেই ভীড় জমাতো I পূজো শেষে পাড়ার প্রতিবাড়ীতে বিজয়ার প্রণাম করতে যেতাম l ঘরে বানানো নাডু নিমকি সহযোগে আপ্যায়ন চলতো ৷ দশমীর দিনেই পোষ্ট কার্ড ইনল্যান্ড এ চিঠিলেখার তোড়জোড় শুরু হত ৷
এই বিশ বছরে সমস্ত কিছু আমূল বদলে গেল। আর এই বদলের কাণ্ডারী চারমূর্তি “কম্পিউটার”,”ইন্টারনেট”,”গুগল” এবং “ফেসবুক” I
দুটি মানুষ আজ মুখোমুখি গল্প না করে মুঠোফোনের আবর্ত্তেবন্দী ৷ আমাদের দৈনন্দিন প্রতিটি কর্মকান্ড(নিতান্ত ব্যক্তিগত, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়সহ) প্রায় রানিং কমেন্ট্রির মত তথাকথিত সোশাল মিডিয়ায় আমজনতার নজরবন্দী ৷ সহজলভ্যতার বাহুল্যে প্রতিটি বিষয় তার গুরুত্ব হারিয়েছে I যেমন ক্যামেরা, গান ৷ প্রতিটি স্মার্ট ফোনেই এফএম, মিডিয়া প্লেয়ার, ক্যামেরা l সবার কানে হেডফোন ৷ ছবির পর ছবি ক্লিক আর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এ মূহুর্তে আপলোড l এসএমএস,হোয়াটসঅ্যাপ, মেলে শারদীয়া শুভেচ্ছা,প্রনাম । কোথায় কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ, আড্ডা? কোথায় সেই আলিঙ্গনের উষ্ণতা?
আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি প্রযুক্তির পিছনে ৷ ইন্টারনেট অফ থিংস কানেক্ট করতে চায় প্রানহীন প্রতিটি জিনিসকে, যাতে আমাদের জীবন আরো অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে নির্ভরশীল ৷ যেমন আজকে আমাদের খুব বেশী কিছু মনে রাখার প্রয়োজন নাই ৷ গুগল সার্চ জিন্দাবাদ ৷ ফেসবুক আজ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ ৷ পুরোটাই যদিও ভার্চুয়াল ৷ এই অতি নির্ভরশীলতা কি ভাল? ভবিষ্যতের গহ্বরে এর উত্তর লেখা থাকবে ৷ যে চারটি প্রযুক্তির কল্যানে (চারমূর্তি) আমরা আজ স্বাচ্ছন্দের (তথাকথিত) চূড়ায়, সহজলভ্যতার নাগপাশে আবদ্ধ, কোন একদিন হয়তো এদেরকেই মানবসভ্যতা ধ্বংসের কাণ্ডারী হিসেবে গণ্য করা হবে ৷ আজকে এই সন্ধিক্ষণে একথা কষ্টকল্পনা, পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে I কিন্তু সাধু সাবধান ।
আজ সতর্ক না হলে আজ থেকে বিশ বছর পরে আর সুযোগ নাও আসতে পারে।
আসুন না একটু শান্তি, একটু আনন্দের খোঁজ করি৷ একটু মনের খবর নিই ৷ শুধুই যুগের হাওয়ায় না ভেসে, গড্ডালিকা প্রবাহে চালিত না হয়ে একটু নিজস্ব চিন্তাভাবনার চেষ্টা করি ৷ শুধুই ব্যস্বাগীশ না হয়ে, অর্থ/সাফল্য/সুখ/ সমৃদ্ধিরূপী মরিচীকার দিকে নিরন্তর না ছুটে, আসুন না একটু হৃদয়ের কথা শুনি ৷ ফিরে আসুক নিজের জন্য, পরিবারের জন্য সময় ৷ যন্ত্র, প্রযুক্তি, মিডিয়া, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি আমাদের যা করাতে/ভাবাতে চাইছে অদৃশ্য অঙ্গুলী হেলনে, সেই চালিকা শক্তির পদানবত না হয়ে আসুন না ঘুরে দাড়াই ৷ এই শারদ প্রাতে আগমনীর সুর আমাদের চেতনা জাগ্রত করুক । নিজস্ব যুক্তিবুদ্ধি , বিবেচনায় সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে আসুক আমাদের স্বকীয়তা ৷
শুধুই একটু উষ্ণতার জন্যে ৷
রেললাইনের ধারে, দোদুল কাশের বনের পাশে অপু-দূর্গার পাশে সেদিন থাকবো আমরাও I আমি-আপনি-তুমি-তোমরা-আপনারা ৷ প্রকৃতির কোলে সত্যিকারের পথের পাঁচালীর অংশীদারত্বে সেদিনই হবে মহামায়ার বোধন ৷ প্রযুক্তি সঙ্গে থাকুক বন্ধু হয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রনে আর আলোকমঞ্জরী তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক এই বিশ্ব ।
“আশ্বিনের সেই শারদপ্রাতে…” আমরা মেতে উঠবো আনন্দযজ্ঞে ।
অপেক্ষায় রইলাম বন্ধু ৷
শুভ শারদীয়া ।