“কেয়া পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে
তাল দিঘীতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে ।”
পাঠক ভাবছেন আমি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “মেঘের কোলে” গানটি নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি | অথবা প্রফুল্ল রায়ের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ।
কিন্তু বন্ধু তা নয় । আপনি আবাক হবেন শুনে আজকের বিষয় “কেয়া চক্রবর্তী” । আর অনেকদিন পরে বাংলায় লিখতেও বেশ ভাল লাগছে।
এমন নয় কেয়া সম্বন্দ্ধে আমি আগে থেকেই অনেক কিছু জানতাম। কিন্তু ওনার বিষয়টি আমার নজরে এল “নাটকের মত” সিনেমা টির মাধ্যমে। যদিও সিনেমাটি এখনও আমি দেখিনি । কিন্তু দেখার ইচ্ছে রয়েছে । ধন্যবাদ দেবেশকে কেয়ার মত একটি নারী চরিত্র কে আমাদের গোচরে আনার জন্যে । আমার বিশ্বাস আমার মত অনেকেই কেয়ার বিষয়ে আগে জানতেন না, বিশেষত যারা সত্তর বা তার পরবর্তী সময়ে জন্মেছেন ।
আমার এই লেখা কিন্তু কোন ভাবেই কেয়ার মৄত্যু রহস্য ঘিরে নয় । কিংবা রুদ্রপ্রসাদ, অজিতেশ বা নান্দীকার এর দ্বন্দ নিয়ে নয় । কারণ এগুলো নিয়ে আমার জানা নেই । তাই মন্তব্য করাও বাতুলতা । নাট্যপ্রেমী হিসেবে আমি রুদ্রপ্রসাদ বাবুর নাটক বা অভিনয় দেখেছি । অজিতেশের অভিনয় সিনেমাতে দেখেছি বা ওনার বিষয়ে পড়েওছি । নাটক বিষয়ে আমার আগ্রহ আমার বাবার থেকে । বাবা নাটক করতেন । পরবর্তী কালে আমিও কিছু নাটক করেছি । সারকারিনা, স্টার থিয়েটার এ কিছু নাটকও দেখেছি এককালে।
কিন্তু তাও কেয়া বিষয়ে আমি কিছুই শুনিনি আগে। দেবেশ এর সিনেমাটিই এ বিষয়ে আমার দৃ্ষ্টি আকর্ষন করে এবং ফলত এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনাও করে ফেলি । আমার নজরে আসে “কেয়ার বই” চিত্তরঞ্জন বাবুর সম্পাদনায়, “কেয়া” দেবেশ এর লেখা । পাশাপাশি পড়ে ফেলি ইন্টারনেট জুড়ে থাকা বিভিন্ন লেখা ও ডকুমেন্ট । কেয়ার নিজের লেখা “মিসেস আর পি সেনগুপ্তা” ।
কেয়ার মত এক অসাধারান প্রতিভাময়ী, সাহসী, ব্যাতিক্রমী বঙ্গরমণীর প্রতি আমার শতকোটি প্রণাম । বঙ্গ সমাজে, বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক আবহ মণ্ডলে এবং তাও সত্তরের দশকে, ওনার প্রতিবাদী সত্তার যে প্রকাশ তা অতুলনীয় । শুধু নাটক কে ভালবেসে কলেজের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনে ঝাপিয়ে পড়ার যে সাহস উনি দেখিয়েছেন, তা বাংলা ও বাঙ্গালীর ইতিহাসে বিরল।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যুর আগে অভিনয় ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য প্রতিভার সাক্ষর উনি রেখেছেন। কিছু নাটক যেমন “চার অধ্যায়”, “ভালমানুষ”, “তিন পয়সার পালা” ।
“জীবন যে রকম” ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে মাঝগঙ্গায় তলিয়ে যান তিনি । নিজের জীবন দিয়েই যেন তিনি এই সিনেমার নাম এবং তার জীবনকে মিলিয়ে দিয়েছেন ।
ছোটবেলা থেকেই কেয়া অন্যরকম । স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার প্রবৃত্তি তার সহজাত । তার আবেগের ধরণগুলো ছিল ভিন্ন । একদিকে তার নমনীয়, কোমল, দরদী মন । আবার অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়ানোর বিরল সাহস ।
ঘরে বাইরে অবিচারকে অস্বীকার করে যেন সমগ্র নারী সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিলেন কেয়া ।
স্বামী, দেওরের সমস্ত ফরমাস সামলে, মুখঝামটা সহ্য করে, সংসারের যাবতীয় দায়ীত্ত পালন করে কেয়া স্টেজে যেতেন, শুধু থিয়েটারকে ভালবেসে । কিন্তু তার শিল্পী সত্তা মুখর হয়ে ওঠে যখন তিনি দেখেন তার সংসার তার প্রকাশের পথে হয়ে ঊঠছে বাধা স্বরূপ ।
এই অসামান্য প্রতিবাদী সত্ত্বাকে আমার কুর্নিশ । বর্তমান সময়ে বাংলা ও বাঙালী জীবনে যেখানে শুধুই মেনে নেওয়ার মানসিকতা, অযথা ঝামেলায় না জড়িয়ে শান্তিকামী যে ভীরু চরিত্রের ভিড়ে লুকিয়ে থাকাকেই আমরা শ্রেয় মনে করছি, সেখানে কেয়া হয়ে উঠুক আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস । নারী, পুরুষ নির্বিশেষে, বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নিক অজস্র কেয়া । গঙ্গার বুক ভরে বয়ে যাক অসংখ্য কেয়া পাতার নৌকো ।
শ্রীজাত এর কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছেঃ
“মানুষ থেকেই মানুষ আসে ।
বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়,
আমরা মানুস, তোমরা মানুষ ।
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায় ।”