“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥“
কবিগুরু এই কবিতাটি অবিভক্ত বাংলা নিয়েই লিখেছিলেন । কিন্তু এখন বাংলাদেশ বলতে অবিবক্ত বাংলার পূর্বাংশ কেই বোঝায় যেখানে পশ্চিমভাগ শুধুই একটি রাজ্য, বৃহৎ একটি দেশের।
এবারের আমার বাংলাদেশ আসার উদ্দেশ্য ব্যাবসায়িক এবং সেটা দেশে রাজধানী ও প্রাণকেন্দ্র ঢাকা তে । তাই আমার এই লেখা “বাংলাদেশের হৃদয় হতে” আমার ভাবনার প্রকাশ এবং এবারের ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা ।
এই একটি দেশে এলেই আমার কখনও বিদেশ বলে মনে হয়নি । ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েও আমার অনেক সময় মনে হয় “অন্য দেশ” । বাংলা, ইংরাজী দূর অস্ত , রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও কেউ বোঝেনা, উপরন্তু তাদের ভাষাও আমার হিব্রু মনে হয় | বিশ্বের অন্য অনেক দেশেও আমার অনুভূতি এক | বাংলাদেশ ব্যাতিক্রম | একই ভাষা, একই রকম মানুষ, একই ধরনের জায়গা | তাছাড়া জন্মগত ভাবেই বাংলাদেশের সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক | আমার জন্ম, বেড়েওঠা, কর্মসবই কোলকাতায় | কিন্তু আমার বাবা ঢাকা বিক্রমপুরের এবং মা বরিশাল , পটুয়াখালির ।
কর্মসূত্রে এবং ভ্রমনে আমি আগে বাংলাদেশে এসেছি । ব্যবসা / কাজ ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বেড়াতে এসে সারা বাংলাদেশ আমি চষে বেড়িয়েছি | বড়িশাল – পটুয়াখালি – টেকনাফ – কক্সবাজার – সেন্টমার্টিনস – বান্দরবন – চট্টগ্রাম – কোথায় নয়?
এবারের আগমন বানিজ্যের বিস্তার এবং এখানকার অন্য উদ্যোগপতি , সরকার ও বানিজ্য সমিতির সাথে মিলে আরো সামগ্রিক, সফল ব্যবসা প্রসারের পরিকল্পনা ৷ এই উদ্যোগ বহুলাংশে সফল এবং এ বিষয়ে এখানকার ভূমিপুত্র দের উৎসাহ লক্ষনীয় |
একটা পুরো দেশ বাঙালিদের, আর তাই এই লেখা বাংলায় | অন্য ভাষাভাষী পাঠকরা মার্জনা করবেন । ভবিষ্যতে কোন এক দিন ইংরাজীতে অনুবাদ ও করা যেতে পারে ৷
এবারের ভ্রমনে আমার বসবাস ফার্মগেট এলাকাতে । এটা শহরের মাঝামাঝি হওয়াতে বিভিন্ন যায়গাতে যাওয়া সহজ ৷ যদিও যানজট এ শহরের প্রাণান্তকর অবস্থা এবারে প্রত্যক্ষ করলাম ৷ এরকমও হয়েছে ১৫ মিনিটের পথ পেরোতে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছে আর ফলতঃ মিটিং করা যায় নি ৷ এ যাত্রায় ঢাকা শহর পুরো চষে বেড়িয়েছি – বাংলা মোটরস, ধানমণ্ডি, মোহাকালি, গুলশান , পান্থপথ , বনশ্রী, বসুন্ধরা ইত্যাদি ৷
শহরের অনেক এলাকাতেই উড়ালপুল, ভূগর্ভস্থ জলনিকাষী ব্যবস্থা করার কাজ চলছে ৷ তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল । এছাড়া রেল, স্বাইবাস, ভূগর্ভস্থ রেল ইত্যাদি ব্যবস্থাতেও নজর দেওয়া উচিত ।
এখানে এখনো প্রচুর দোতলা বাস চলে ৷ নিজস্ব গাড়ী ছাড়া যাতায়াত করা কষ্টকর ৷ আর তাই অধিকাংশ লোকেরই গাড়ী আছে । চার ঢাকা গাড়ীর ক্ষেত্র মোটামুটি টয়োটা গাড়ীর দখলে | এমন অনেক মডেল আছে যা ভারতে দেখা যায় না, যেমন Noha, Towance, Have, Gremio ইত্যাদি | এছাড়া আছে প্রচুর অটো | অটো কিন্তু খাঁচায় বন্দী | চুরি, ছিনতাই রোখার জন্যই নাকি এই অবস্থা ! প্রচুর দোতলা বাস আমার ছেলেবলার নস্টালজিয়া উসকে দিল | কোলকাতায় এখন তো দোতলা বাস নেই-ই |
বাংলাদেশের আসল বৈশিষ্ট লুকিয়ে এখানকার মানুষের মাঝে । বাংলা ভাষা, জাতিসত্ত্বার প্রতি আবেগ, দেশের প্রতি প্রেম অতুলনীয় । যেখানেই গেছি, মানুষের মধ্যে যে আন্তরিকতা দেখেছি, তা আমাদের কোলকাতাতেও বিরল | যে কোন মিটিং এই গেছি, প্রথমেই এসেছে খাবার – চা- স্যান্ডউইচ-ডাবের জল-ফল-ভাত-মাংস-বিরিয়ানি-মিষ্টি বিভিন্ন খাবার সংযোগে আপ্যায়ন | কেউ বা দিলেন পরবর্তী দিনের দ্বিপ্রাহরিক বা রাত্রিকালীন ভোজনের আমন্ত্রন (দাওয়াত)। এমন অনেক মানুষের সাথেও আলাপ হল যাদের সাথে প্রথম বার দেখা । সেখানেও যে রকম আপ্যায়ন এবং উপহার পেলাম তা সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শেষদিনে বইমেলাও ঘুরে এলাম । বইমেলার পরিবেশ, বই এর দোকানের কাঠামো নজর কাড়ল । বন্ধ খাঁচা নয়, বরং খোলা দোকান, ছারপাশ দিয়ে ঘুরে বই দেখা যায় । খাবারের দোকান বা বই ছাড়া আন্যান্য বিষয় বিক্রির বাহুল্যা নেই । হুমায়ুন আহমেদ এর একটি বই ও কিনলাম মেলার স্মৃতি হিসেবে ।
এযাত্রায় ব্যবসায়িক যোগাযোগ যেমন স্থাপন হল, তেমনি প্রযুক্তি, শিল্পকলা, সংস্কৃতি আদান প্রদান এর ক্ষেত্রও প্রস্তুত হল । আশা করি, এই সম্পর্কের সুত্র ধরেই আবার ঘন ঘন যাতায়াত হবে এবং বাংলাদেশের হ্রদয় কে আরও কাছাকাছি স্পর্শ করার সুযোগ হবে । ফেরার পথে পাওয়া উপহার কালিজিরা চাল, গুড় এবারের যাত্রা কে পূর্ণতা দিল ।
আসছি বাংলাদেশ । ফিরে আসছি । বাংলা আর বাঙ্গালীর আসল রুপের পরিচয় পেতে ফিরে আসব বারবার।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লেখার অংশ দিয়ে আজকের একুশে ফেব্রুয়ারীর লেখা শেষ করি :
আমি বাংলায় গান গাই,
আমি বাংলার গান গাই,
আমি, আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই ।
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন,
আমি বাংলায় বাঁধি সুর,
আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর ।
বাংলা আমার জীবনানন্দ,
বাংলা প্রানের সুর,
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ ।
আমি বাংলায় কথা কই,
আমি বাংলার কথা কই,
আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই ।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে,
করি বাংলায় হাহাকার,
আমি সব দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ।
বাংলাই আমার দৃপ্ত স্লোগান,
ক্ষিপ্ত তীর ধনুক,
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ ।
আমি বাংলায় ভালবাসি,
আমি বাংলাকে ভালবাসি,
আমি তারি হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি ।
আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি,
বিনম্র শ্রদ্ধায়,
মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায় ।
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল,
তৃপ্ত শেষ চুমুক,
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ ।
আমি বাংলায় গান গাই,
আমি বাংলার গান গাই,
আমি, আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই ।
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন,
আমি বাংলায় বাঁধি সুর,
আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর ।
বাংলা আমার জীবনানন্দ,
বাংলা প্রানের সুর,
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ ।
February 28, 2016 at 1:37 am
IT IS VERY INTERESTING TO SEE Dhaka by the insight of Bengali Nieghbour from intellectual capital Kolkata!